প্রথম আলোর একটা শ্লোগান আছে, “যা কিছু ভালো তার সঙ্গেই প্রথম আলো”। এই শ্লোগানের মধ্যে একটা বিরাট সমস্যা আছে যা সাদা চোখে ধরা যায় না।প্রথম আলোর বক্তব্যটাই জাতিবাদী রাজনীতির একটা মৌলিক ঘোষণা। জাতিবাদী চিন্তার সমস্যা কী? কীভাবে জাতিবাদী চিন্তাকে আমরা বুঝতে পারবো?জাতিবাদী চিন্তা ও রাজনীতি আমরা সবাই কমবেশি চিনি। তবু এই চেনা একদম সহজ করে দেয়ার জন্য দুটা খুব সাধারণ চিহ্নের কথা বলবো।
প্রথমতঃ জাতিবাদ কোন না কোন আইডেনটিটি বা পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতির কথা বলবেই। তাই জাতি মানেই পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতি। তাতে অসুবিধা হল,সেক্ষেত্রে জাতিবাদ সোজা মানে করবে যে, যারা ঐ পরিচয়ের নয় তারা খারাপ, তারা শত্রু আর তাঁদের চেয়ে নিজ পরিচয়ের লোকেরা শ্রেষ্ঠ। আর কোন না কোন পরিচয় বলতে যেমন ধর্মীয় জাতির পরিচয় বা, ভাষাভিত্তিক জাতি,গায়ের রংয়ের ভিত্তিক ফর্সা না কালো যেমন, অথবা ভুগঠনের ভুগোল ভিত্তিক যেমন পাহাড়ি না সমতলি এভাবে অসংখ্য পরিচয়ভিত্তিক জাতি খাড়া করা সম্ভব এবং তা দুনিয়াতে আছে। এসবই একেকটা জাতিবাদী চিন্তা ও রাজনীতি।
আর দ্বিতীয়তঃ জাতিবাদী আরেক সুনির্দিষ্ট সাধারণ চিহ্ন আছে তা হল “শ্রেষ্ঠত্ববাদ”। জাতিবাদী চিন্তা মানেই সেখানে একটা খামোখা ‘শ্রেষ্ঠত্ব’ চিন্তা থাকবেই। যেখান থেকে অন্যের চেয়ে আপনি ভাল, আপনি শ্রেষ্ঠ,আপনার জাতটা মহান অতএব অন্যকে তা মানতে বাধ্য করা। জাতিবাদ শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়। যা কিছু নিজের সবকিছুকেই “ভাল” বলে দাবী করে। যা কিছু তার নয় সে তাকে “অপর” বা আদার বলে।যেমন ধরেন যারা আওয়ামী লীগ করেনা বা সমর্থন করেনা তাদের আওয়ামী লীগারেরা মনে করে ‘শয়তান’ বা খারাপ লোক বলে। আওয়ামী লীগারেরা বিশ্বাস করে যারা তার পলিটিক্যাল অপোনেন্ট, তারা পাকিস্তানের দালাল, তারা জামায়তে ইসলামীর টাকা খেয়ে লেখালেখি করে। একবার বাংলাদেশের বিশিষ্ট হিন্দুত্ববাদী সাংবাদিক পুলক ঘটক আমাকে নিয়ে পোষ্ট দিয়েছিলো সেইখানে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের আমেরিকার নেতা শিতাংশু গুহ কমেন্ট করে বলেছিলো, “পিনাকী ভট্টাচার্য হিন্দু হতে পারেনা কারণ হিন্দুরা এতো খারাপ হতে পারে না”। খুব কৌতুহল উদ্দিপক এবং জাতিবাদি চিন্তা বুঝার জন্য প্রাসঙ্গিক কমেন্ট এটা। এই কথাটার সার অর্থ হচ্ছে, “হিন্দুরা সবাই মোটামুটি ভালো দুয়েকটা হয়তো ব্যতিক্রম থাকতে পারে। কিন্তু অন্যরা সবাই খুব খারাপ।” এই জাতিবাদি রাজনীতিই হিন্দুদের সম্পর্কে আরেকটা শ্লোগান তৈরি করেছিলো উর্দু ভাষায়, “*লাউন কা বাচ্চা কাভি নেহি আচ্ছা, যো ভি আচ্ছা, উয়ো ভি শুয়োরকা বাচ্চা”। সীতাংশুর কমেন্ট আর এই উর্দু স্লোগান মুলগতভাবে একই।
এভাবেই জাতিবাদী রাজনীতি মানুষকে ইন গ্রুপ মানে নিজের দলের লোক আর আদারে মানে “অপর” হিসেবে ভাগ করে ফেলে। শুধু তাই নয়, ইন গ্রুপে সব ভালো জিনিস আছে আর আদার গ্রুপে সব খারাপ জিনিস থাকে এইটা সে ভাবতে থাকে।জাতিবাদি হলে আপনাকে যা করতে হবে, তা হচ্ছেঃ আপনি হিন্দু হলে হিন্দুর (ধর্মভিত্তিক হিন্দুজাতির সকলের) আর মুসলমান হলে (মুসলমান জাতির সকলের) পক্ষে চোখ বন্ধ করে থাকতে হবে। সোজা কথায় ন্যায়-অন্যায় বলে কিছু নাই, বে-ইনসাফি হলেও। কারণ জাতিবাদে ইনসাফের বিবেচনা প্রধান না বরং জাতি প্রধান বিবেচনা।
এর ফলে যেই সমস্যা হয় তা হচ্ছে, সে আদারের সাথে এনগেইজড হতে পারেনা। আদারের সাথে সে কোন ভাবেই ইন্টারেক্ট করতে পারেনা। আদারের সাথে সম্পর্কিত কোন জিনিসকে সে গ্রহণ করতে পারেনা। বাংলাদেশে বাঙালি জাতিবাদি রাজনীতির অনিবার্য অনুসঙ্গ হিসেবে জন্ম নিয়েছে আজকের অনতিক্রম্য বিভাজন। এটাই জাতিবাদি রাজনীতির ভবিতব্য। জাতিবাদি রাজনীতি অনিবার্যভাবেই তাই ফ্যাসিবাদে পর্যবসিত হয়।
জাতিবাদিরা যেটা আমলে নেয়না তা হচ্ছে, বৈষম্যহীনভাবে নাগরিক মাত্রই সবাই সম অধিকারের নাগরিক বলে বিবেচিত হবে – এটা হলেই সব প্রশ্নের সমাধান সম্ভব। আমরা সবসময়েই এমন একটা রাষ্ট্রের কল্পনা করতে পারি যেইখানে ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, জাতি, লিঙ্গ যে কোন পরিচয়ের উর্ধে উঠে সমান নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব।কিন্তু যখনই আমাদের মধ্যে কেউ আমার গ্রুপের আধিপত্য চাই আর সেই গ্রুপ বলতে একটা না একটা জাতি পরিচয়কে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে নিজ প্রুপ বা দল সাজাবো, সেখান থেকেই সমস্যার শুরু হবে। যেমন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ সাজানোতে হিন্দুদের কোন নাগরিক অধিকারের সমাধান দিবেনা। উলটা ধর্মীয় পরিচয় ভিত্তিক ভাগাভাগি রেষারেষি বাড়াবে। ধর্মীয় বা যেকোন পরিচয়ভিত্তিক রাষ্ট্র এমন ভাগাভাগির সমস্যাই আরো জোরদার করবে।
অতএব সমাধান একটাই; সব পরিচয়ে ভাগ হয়ে যাবার উর্ধে পরিচয় নির্বিশেষে সম-নাগরিক অধিকার এই ভিত্তিক রাষ্ট্র।নাগরিক অধিকার আর সাম্যের প্রশ্নে যে কোন পরিচয়কে বিবেচ্য করলে তা অপর পরিচয়কে পদানত করে রাখবে। বাঙালি পরিচয়ের ভিত্তিতে রাষ্ট্র করলে সে অন্য জাতিকে পদানত করবে বা দ্বিতীয় শ্রেনীর নাগরিক বানাবে, এমনকি ইসলামী পরিচয়ে রাষ্ট্র বানালে তা শুধু অন্য ধর্মই শুধু নয় এমনকি খোদ ইসলাম ধর্মের অনুসারিদের মধ্যে সংখ্যালঘু অংশকে পদানত করে ফেলবে। যেকোন ধর্মেই তো সেক্ট আছে ফ্যাকড়া আছে, তাই সংখ্যাগুরু সেক্ট বা ফ্যাকড়া নিজে ধর্মের সংখ্যালঘু সেক্টকে পদানত করে ফেলবে। ভারতেই এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে, হিন্দুরাই দলিতদের পদানত করে রেখেছে তারা ধর্ম পরিচয়ে হিন্দু হলেও।
রাষ্ট্র গঠনের সময়ে পরিচয়ের ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠনের সমস্যা নিয়ে সতর্ক থাকুন আর সাম্য, সম অধিকার আর নাগরিকদের সম অধিকারের নাগরিকতার প্রশ্নে নিরাপোষ থাকুন। অপরের সাথে এনগেইজ হবার জায়গা খুজে বের করুন। অপরের সাথে এনগেইজ হবার জায়গা আছেই, থাকতেই হবে, একটা সমাজে থাকতে গেলে কমন ইন্টারেস্টের জায়গা থাকতেই হবে। অপরের মাঝে ভালো মঙ্গলজনক কিছু নাই এবং নিজেদের মধ্যেই সব ভালো কিছু সেই চিন্তা বাদ দিন।পরিশেষে কোথাও শ্রেষ্ঠত্বের আলাপ উঠে আসলে বুঝবেন বিপদ ঘনিয়ে আসছে। কোথাও ভুল করেছেন।
সাবধান হন!!