অনেকটা নিঃশব্দেই চলে গেলেন আমাদের হেড স্যার। “হেড স্যার” বললে বগুড়ার এক প্রজন্মের মনের গহীনে যে অজানা অনুরনন হয় তা অবশ্য সবার জানার কথা নয়। যখন এই লেখাটা লিখছি তখন আমাদের চৈতনের মহানায়ক বগুড়া জেলা স্কুলের এক সময়ের প্রধান শিক্ষক তাজমিলুর রহমান অন্তিম শয্যায়। ছোটখাটো গড়নের এই মানুষটা একটা প্রজন্মের মনোজগতে কীভাবে এক অবিস্মরণীয় সম্রাট হয়ে বসেছিলেন সেটা এক বিস্ময় হয়ে থাকবে। শিক্ষক হয়েও শুধু শিক্ষাগুরু নন, ঠিক কোথায় যেন উনি সব কিছুকে ছাপিয়ে অন্য একটা কিছু হয়ে উঠেছিলেন, সেটা যে কী তা আমরাও হয়ত খুব গুছিয়ে বলতে পারবোনা। এই খানেই হেড স্যার অনন্য। সেই বিশাল মহিরুহের ছায়া অকস্মাৎ অন্তর্হিত হল, উজ্জ্বল সেই শুকতারা নিভে গেল।
স্যার কে একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, শিক্ষকতার এই পেশায় ভালো কেউ আসছেনা তার কারন কি এটা যে এই পেশায় উপার্জন কম? স্যার হেসে উত্তর দিয়েছিলেন, “আপনি বলতে পারবেন কত উপার্জন হলে সেটাকে কেউ যথেষ্ট মনে করবে? শিক্ষকতা তপস্যার মত, তপস্বী হতে না পারলে এই পেশায় না আসাই উচিত।“ তাজমিলুর রহমান ছিলেন সেই তপস্বী, এ শুধু জ্ঞানের তপস্যা নয়, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মানুষ বানানোর তপস্যা; যে তপস্যায় মোক্ষলাভ করেছিলেন আমাদের প্রিয় হেড স্যার।
যেদিন বাংলাদেশ টেলিভিশনে সত্যজিৎ রায়ের হীরক রাজার দেশে দেখান হোল, বাংলাদেশে তখন চলছিলো এরশাদের জংলী শাসন। পরদিন জেলা স্কুলের মতো সরকারী স্কুলের সকালের অ্যাসেম্বলিতে তাজমিলুর স্যার অন্যায় শাসন আর সেই শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের মন্ত্রে প্রায় এক ঘণ্টার এক দুর্দান্ত বক্তৃতায় আমাদের উদ্বুদ্ধ করে ন্যায়ের জন্য সংগ্রামের শিক্ষা দিয়েছিলেন । আমরা সৈনিকের মতো নিশ্চল দাড়িয়ে সেই দীক্ষা নিয়েছিলাম। আমাদের সামনে সেদিন তাজমিলুর রহমান হঠাৎ ই হয়ে ওঠেন সেই নিবারন পণ্ডিত, আর আমরা বন্ধ করে দেয়া নিবারন পণ্ডিতের পাঠশালার রুখে দাঁড়ানো ছাত্র। বাস্তবেও তাই হয়েছিল। আমাদের সেই প্রজন্মই এক ঐতিহাসিক গন অভ্যুথানে ৯০ এ স্বৈরশাসনের পতন ঘটায়। আমার দেখা মতে সেদিনের এসেম্বলিতে দাঁড়ানো সবাই ছিল সেই গন অভ্যুথানের রাজপথ কাঁপানো সৈনিক।
স্যার কে ঘিরে অনেক আনন্দের অভিজ্ঞতাও আছে। স্যার ছাত্রদের সেরা টিফিনটা খাওয়ানোর চেষ্টা করতেন, আবার টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে মাঝে মাঝে স্কুলে দারুন ভোজ দিতেন। আমরা বাসা থেকে প্লেট গ্লাস বগলে নিয়ে স্কুলের বারান্দায় বসে যেতাম। খাবার মাঝে স্যার এসে শ্লোগান ধরতেন, উঁচু গলায় বলতেন, “খাচ্ছ কেমন? আমরা চিৎকার করে বলতাম, “খুব খুব”, আবার স্যার বলতেন’”লাগছে কেমন?” আমরা বলতাম “বেশ বেশ”। স্যার এর মুখ হাসিতে ভরে উঠত; আমাদের আনন্দে উনি অপার আনন্দ পেতেন। এভাবেই পুত্রবৎ বাৎসল্যে আর সুনিবিড় যত্নে উনি গড়ে গেছেন প্রজন্মের পর প্রজন্ম।
আজ মনে হয় বগুড়ার আমাদের প্রজন্ম অনেক ভাগ্যবান, পৃথিবী আমাদের বঞ্চিত করেনি, বরং তাজমিলুর রহমানের মতো এক অসাধারণ শিক্ষাগুরুকে আমাদের উপহার দিয়েছে।
আমি বুঝছিনা, আমার কাঁদা উচিত কিনা, বোধ হয় না, সেই শিক্ষা স্যার আমাদের দেননি। কিন্তু কাদতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে। শোকের রঙ এত প্রগার যে বুক ভাঙ্গা কান্নায় শেষ যাত্রার আগে স্যার এর পবিত্র পদতল ধুয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। যে আকাশ ছোবার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন শুকতারা নিভে গেলে সেই আকাশ যেমন না কেদে অপেক্ষা করে তেমনি আরেকজন প্রবাদতুল্য তাজমিলুর রহমানের জন্য অপেক্ষায় থাকবে আগামীর আকাশ। আমরাও অপেক্ষায় রইলাম। মহাপুরুষের অনন্ত যাত্রায় অনুসারীদের শোকে বিহ্বল হতে নেই।