কোন গণ আন্দোলন নিয়ে আন্দোলনকারীরা একটা ডিস কোর্স তৈরি করার চেষ্টা করে। তাঁর দাবীর গ্রহণযোগ্যতা তুলে ধরার চেষ্টা করে। আর উল্টো দিকে যাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন তারা এই আন্দোলন নিয়ে তাদের বয়ান তৈরি করে। যেমন শাহবাগের দাবী ছিল যুদ্ধাপরাধীর জন্য সর্বোচ্চ শাস্তির দাবীর আন্দোলন, আর যুদ্ধাপরাধীদের যারা পক্ষে তারা শাহবাগ কে চিত্রিত করার চেষ্টা চালাল “নাস্তিকদের আন্দোলন” বলে। তাদের তৈরি পাল্টা বয়ানে যুদ্ধাপরাধের বিষয়টাই থাকলো না। এই পাল্টা বয়ান তৈরি করা হয় যখন তৈরি হওয়া আন্দোলন এতটাই যৌক্তিক হয়ে ওঠে যে নিজের দলের লোকদের আন্দোলনকারীদের সাথে একাত্ম যাওয়ার উপক্রম হয়।
সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলন নিয়ে ঠিক তেমনি পাল্টা বয়ান তৈরি করছে সরকার এবং তাদের সমর্থকেরা। তারা বলতে চাইছে এটা একটা পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন। আন্দোলনে পরিবেশ আছে কিন্তু আমাদের আন্দোলন নিছক পরিবেশ বাঁচানোর আন্দোলন নয়। আমরা নিছক পরিবেশবাদী নই। আমাদের সুনির্দিষ্ট সাতটি দাবী আছে।
১/ গ্যাস ও কয়লা সম্পদে জাতীয় মালিকানা নিশ্চিত করতে হবে। শতকরা একশ ভাগ গ্যাস ও শতকরা একশ ভাগ কয়লা বাংলাদেশের কাজে, বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করতে হবে। তাই এই কয়লা বা গ্যাস বিদেশী মালিকানায় দেওযা যাবে না, বিদেশে পাচার করার লক্ষ্যে রপ্তানিমুখী কোনো চুক্তিও তাই থাকা চলবে না। দুর্নীতি করবার দায়মুক্তি আইন বাতিল করে ‘খনিজ সম্পদ রফতানি নিষিদ্ধ’ করবার আইন করতে হবে।
২/ বিদ্যুৎকে গণপণ্য হিসেবে বিবেচনা করে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে দেশীয় মালিকানায় বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট স্থাপনের নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। এক্ষেত্রে বেশি দামে বিদ্যুৎ কেনার ও বিদ্যুৎ খাতকে বহুজাতিক কোম্পানির হাতে জিম্মি করবার বিদ্যমান নীতি, চুক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা থেকে দেশকে সম্পূর্ণ মুক্ত করতে হবে। রামপাল ও রূপপুরের দেশবিধ্বংসী প্রকল্প বাতিল করতে হবে।
৩/ বেআইনীভাবে বাংলাদেশের কয়লা দেখিয়ে বিদেশে শেয়ার ব্যবসার অর্থ জরিমানা হিসেবে আদায করে, এশিয়া এনার্জিকে (জিসিএম) দেশ থেকে বহিষ্কার ও উন্মুক্ত খনন পদ্ধতি নিষিদ্ধ সহ ফুলবাড়ী চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে। বাংলাদেশের আবাদী জমি, পানিসম্পদ ও জনবসতি বিবেচনা করে উপযুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারের জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিতে হবে।
৪/ পিএসসি প্রক্রিয়া বাতিল করে স্থলভাগে ও সমুদ্রে নতুন নতুন গ্যাস ক্ষেত্র অনুসন্ধানে জাতীয় সংস্থাকে প্রয়োজনীয় সুযোগ, ক্ষমতা ও বরাদ্দ দিতে হবে। সুনেত্র, ছাতক, তিতাস, হবিগঞ্জ, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সমুদ্রসীমার যে উল্ল্যেখযোগ্য নতুন মজুতের সম্ভবাবনা আছে সেগুলোর অনুসন্ধান, উত্তোলন ও শতভাগ মালিকানা নিশ্চিত করতে হবে। এগুলোর ওপর ভিত্তি করে দীর্ঘমেয়াদে বৃহৎ গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট স্থাপন করবার কাজ শুরু করতে হবে।
৫/ জাতীয় সম্পদের উপর জাতীয় কর্তৃত্ব নিশ্চিত করবার জন্য জাতীয় প্রতিষ্ঠানের বিকাশ ঘটাতে হবে। এজন্য বাপেক্স, পে্েট্রাবাংলা, জিওলজিক্যাল সার্ভে ও ব্যুরো অব মিনারেল ডেভেলপমেন্ট এর যথাযথ উন্নয়ন এবং অবিলম্বে প্রস্তাবিত খনি বাংলা কার্যকর জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসাবে দাঁড় করতে হবে। খনিজসম্পদ উন্নয়ন ও তার সর্বোত্তম ব্যবহারে জনশক্তি গড়ে তোলার জন্য বিশ্ববিদ্যলয় পর্যায়ে আরও বিভাগ এবং জাতীয় ভাবে বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে হবে। এ কাজে প্রবাসী বাংলাদেশী বিশেষজ্ঞ ও প্রয়োজনে বিদেশী বিশেষজ্ঞদের কাজে লাগাতে হবে।
৬/ বিদ্যুৎ খাতে আশু কাজ হচ্ছে, রেন্টাল পাওয়ারের চুক্তি বাতিল করে রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট চালু, মেরামত ও নবায়ন করা।
৭/ জাতীয় স্বার্থ, স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে জ্বালানী নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, পরিবেশ ও জনস্বার্থ নিশ্চিত করার মাধ্যমে নবায়নযোগ্য ও অনাবায়যোগ্য জ্বালানী সম্পদের সর্বোত্তম মিশ্রণ ঘটিয়ে একটি জ্বালানী নীতি প্রণয়ন করে তার জন্য প্রয়োজনীর প্রতিষ্ঠানিক কাঠামো নির্মাণ শুরু করতে হবে।
সর্বোপরি, এই আন্দোলন নিজ ভূখণ্ড, প্রাকৃতিক সম্পদ, নিজ মনন, অস্তিত্বের ওপর মালিকানা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন।
লেখাটির ফেইসবুক ভার্সন পড়তে চাইলে এইখানে ক্লিক করুন